প্রতি বছর বর্ষা এলেই বাংলাদেশের নদীতীরবর্তী অঞ্চলে যে অনিশ্চয়তা আর ভয় নেমে আসে, তা এক চিরন্তন গল্প। প্রলয়ঙ্করী বন্যা কেবল ঘরবাড়ি ভাসিয়ে নেয় না, ভাসিয়ে নিয়ে যায় মানুষের স্বপ্ন, জীবিকা আর ভবিষ্যতের আশা। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (WFP)-এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদনগুলো এই চ্যালেঞ্জের এক করুণ চিত্র তুলে ধরছে, যেখানে বলা হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বন্যা এখন আরও ঘন ঘন ও তীব্র হচ্ছে। কিন্তু এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখেও হার মানতে নারাজ বাংলাদেশের মানুষ। তারা এখন শিখছে, কীভাবে বন্যার সঙ্গেই টিকে থাকা যায়, কীভাবে ‘উঁচু জমিতে নিরাপত্তা’ খুঁজে নেওয়া যায়।

এক নতুন যুদ্ধ: প্রকৃতির সঙ্গে আপস নয়, সহাবস্থান
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। ফলে বন্যা এখানকার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু গত কয়েক দশকে, বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে, বন্যার ধরন বদলে গেছে। এটি এখন শুধু কৃষিজমি বা গ্রামের রাস্তা ডুবিয়ে দেয় না, গ্রামীণ অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেয়, শিশুদের শিক্ষা ব্যাহত করে এবং স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ায়। দরিদ্র এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, যারা নদী বা নিচু জমিতে বাস করে, তাদের উপর এই আঘাত সবচেয়ে বেশি।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচী এবং অন্যান্য সাহায্য সংস্থাগুলির সঙ্গে কাজ করে বাংলাদেশের কিছু সম্প্রদায় এখন প্রথাগত পদ্ধতির বাইরে গিয়ে নতুন কৌশল গ্রহণ করছে। তারা কেবল ত্রাণের অপেক্ষায় বসে নেই, বরং এমন সব সমাধান খুঁজছে যা তাদের দীর্ঘমেয়াদে বন্যার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে সাহায্য করবে।

‘উঁচু ভূমি’: শুধু একটি ঠিকানা নয়, একটি কৌশল
বন্যা মোকাবিলায় ‘উঁচু ভূমি’ এখন কেবল ভৌগোলিক ধারণা নয়, এটি এক ধরনের জীবনযাত্রার কৌশল। এর মধ্যে রয়েছে:
- উঁচু প্ল্যাটফর্মে ঘরবাড়ি নির্মাণ: সাধারণ মাটির বাড়ি বা বাঁশের কুঁড়েঘরের বদলে, মাটিকে উঁচু করে প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে তার উপর বাড়ি বানানো হচ্ছে। এতে বন্যার পানি বাড়লেও ঘরগুলো সুরক্ষিত থাকছে।
- ভাসমান বা পোর্টেবল কাঠামো: কিছু এলাকায় ভাসমান স্কুল বা কমিউনিটি সেন্টার তৈরি হচ্ছে, যা বন্যার সময়ও শিক্ষা ও সামাজিক কার্যক্রম চালিয়ে যেতে সাহায্য করে।
- সচেতনতা ও প্রশিক্ষণ: কোন এলাকা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ, কখন পানি বাড়বে, জরুরি অবস্থায় কোথায় আশ্রয় নিতে হবে—এসব বিষয়ে গ্রামবাসীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে নারী ও শিশুদের জন্য নিরাপদ স্থানে পৌঁছানোর প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণ অত্যন্ত জরুরি।
- জলবায়ু-সহনশীল কৃষি: যে ফসল অল্প পানিতে নষ্ট হয় না, বা বন্যা পরবর্তী সময়ে দ্রুত ফলন দেয়, সেই ধরনের বীজ ও কৃষিপদ্ধতির প্রচলন করা হচ্ছে। এতে বন্যার পরও মানুষ দ্রুত নিজেদের খাদ্যের সংস্থান করতে পারে।
দীর্ঘমেয়াদী স্থায়িত্বের পথে
এই উদ্যোগগুলো কেবল সাময়িক স্বস্তি দিচ্ছে না, বরং বন্যাপ্রবণ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে এক নতুন ধরনের মানসিক শক্তি তৈরি করছে। তারা বুঝতে পারছে, প্রকৃতির বিধ্বংসী রূপকে হয়তো পুরোপুরি থামানো যাবে না, কিন্তু তার সঙ্গে যুদ্ধ না করে কীভাবে নিজেদের জীবন ও জীবিকাকে সুরক্ষিত রাখা যায়, সেই পথ খুঁজে নিতে হবে।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির মতো সংস্থাগুলো এই কাজে প্রযুক্তিগত সহায়তা, খাদ্য সরবরাহ এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সাহায্য করছে। তাদের লক্ষ্য হলো—বাংলাদেশের প্রতিটি বন্যাপ্রবণ পরিবার যেন নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে পারে এবং ভবিষ্যতে আরও বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগের মোকাবিলায় সক্ষম হয়। এটি কেবল ত্রাণের কাজ নয়, এটি মানুষের মর্যাদা ও আত্মনির্ভরশীলতা ফিরিয়ে আনার এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। বাংলাদেশের এই অভিজ্ঞতা, জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর জন্যও একটি অনুপ্রেরণা হতে পারে, যেখানে প্রকৃতির ধ্বংসলীলার মধ্যেও টিকে থাকার এবং ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প লেখা হচ্ছে।






