ডিজিটাল দুনিয়ার আধুনিক ‘মহারাজারা’ এখন তাদের নতুন রাজ্য বিস্তারের জন্য ভারতের দিকে নজর দিয়েছে। গুগল, ওপেনএআই, এবং পারপ্লেক্সিটি এআই-এর মতো প্রযুক্তিগত সুপারপাওয়াররা হঠাৎ করেই যেন ‘বদান্যতার’ চাদর গায়ে জড়িয়েছে—ভারতের কোণে কোণে তারা বিলিয়ে দিচ্ছে তাদের সবচেয়ে উন্নত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পরিষেবাগুলি, তাও আবার সম্পূর্ণ বিনামূল্যে! কিন্তু এই ‘মুক্ত দান’-এর পেছনে কি লুকিয়ে আছে এক নতুন ডিজিটাল সাম্রাজ্যবাদের বীজ?
‘মুক্ত বাতাস’-এর আড়ালে ডেটা-লুণ্ঠন?
এআই কোম্পানিগুলোর এই উদারতা আপাতদৃষ্টিতে ভারতের মতো বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য দারুণ এক সুযোগ। কল্পনা করুন, কোটি কোটি মানুষ হঠাৎ করে বিশ্বমানের এআই টুলস ব্যবহার করে তাদের দৈনন্দিন জীবনকে আরও সহজ করতে পারছে। কিন্তু এই ‘মুক্ত বাতাস’ কি কেবলই ডেটা সংগ্রহের জন্য পাতা এক বিশাল ফাঁদ?
প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ‘বিনামূল্যে’ দেওয়ার খেলাটি আসলে ভবিষ্যতের ডেটা সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রথম ধাপ। ভারত একটি তরুণ, মোবাইল-সচেতন এবং প্রযুক্তি-প্রেমী দেশ। এখানে স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা অবিশ্বাস্য, এবং প্রতিদিন নতুন নতুন মানুষ ইন্টারনেটের জগতে পা রাখছে। এই বিশাল জনগোষ্ঠী প্রতিদিন যে বিপুল পরিমাণ ডেটা তৈরি করছে, তা এআই মডেল প্রশিক্ষণের জন্য স্বর্ণের চেয়েও মূল্যবান।
যখন আপনি বিনামূল্যে একটি এআই চ্যাটবট ব্যবহার করছেন, তখন প্রতিটি প্রশ্ন, প্রতিটি উত্তর, প্রতিটি মিথস্ক্রিয়া আসলে সেই এআই মডেলকে আরও বুদ্ধিমান করে তুলছে। আপনি নিজের অজান্তেই এআই-কে তার ডেটাবেস সমৃদ্ধ করতে সাহায্য করছেন। উন্নত দেশগুলোতে ডেটা গোপনীয়তার আইন বেশ কঠোর হওয়ায় এমন অবাধ ডেটা সংগ্রহ প্রায় অসম্ভব। কিন্তু ভারতে সেই বিধিনিষেধ এখনো ততটা শক্তিশালী নয়, যা বিদেশি প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর জন্য একটি ‘সুবিধাজনক’ পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
ভাষার বৈচিত্র্য: এআই-এর নতুন দিগন্ত
ভারতের ভাষাগত বৈচিত্র্যও এআই কোম্পানিগুলোর নজরে। বাংলা, হিন্দি, তামিল, তেলেগু—সহ অজস্র আঞ্চলিক ভাষাভাষী মানুষ এখানে বসবাস করে। এই বিপুল ডেটা ব্যবহার করে এআই মডেলগুলিকে যদি এই আঞ্চলিক ভাষাগুলিতে প্রশিক্ষিত করা যায়, তবে তা কেবল ভারতীয় বাজার নয়, বিশ্বের অন্যান্য বহুভাষিক দেশগুলিতেও তাদের এআই পণ্যের বাজার খুলে দেবে। এটি ‘এক ঢিলে দুই পাখি মারা’-র মতো এক স্মার্ট কৌশল।

ভারতের জন্য মোড়: ডেটা সার্বভৌমত্ব বনাম প্রযুক্তি অ্যাক্সেস
এই পরিস্থিতি ভারতের জন্য এক জটিল প্রশ্ন সামনে নিয়ে আসছে:
- ডেটা সার্বভৌমত্ব: আমাদের দেশের ডেটা কি বিদেশি কোম্পানিগুলোর হাতে অবাধে চলে যাবে? এর সুরক্ষায় আমাদের নিজস্ব আইন কতটা কার্যকর?
- প্রযুক্তিগত অ্যাক্সেস: বিনামূল্যে অত্যাধুনিক এআই ব্যবহার করার সুযোগ কি আমাদের নিজস্ব এআই শিল্পের বিকাশে বাধা দেবে, নাকি সাহায্য করবে?
আজ আমরা হয়তো বিনামূল্যে অত্যাধুনিক এআই পরিষেবা উপভোগ করছি, কিন্তু আগামীকাল যখন এই কোম্পানিগুলো তাদের পরিষেবা ‘পেইড’ করে দেবে, তখন কি আমরা তাদের ডেটা সাম্রাজ্যের স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যাব? ভারতের নীতি নির্ধারকদের এখন থেকেই এই গভীর প্রশ্নগুলির উত্তর খুঁজতে হবে, যাতে প্রযুক্তিগত অগ্রগতি আমাদের সার্বভৌমত্ব এবং ডেটা সুরক্ষাকে বিপন্ন না করে





