প্রথম চাপ: মৃত্যুদণ্ড এবং প্রত্যর্পণের নতুন আবেদন
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর ক্ষমতাচ্যুত হওয়া শেখ হাসিনা বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছেন। সম্প্রতি, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (ICT) তাঁকে ‘মানবতাবিরোধী অপরাধে’ মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার পরই, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার ভারতকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যর্পণের অনুরোধ জানিয়ে একটি কূটনৈতিক চিঠি পাঠিয়েছে। এর আগেও ঢাকা অনানুষ্ঠানিকভাবে আবেদন জানালেও, রায় ঘোষণার পর বিষয়টি নতুন মাত্রা পেয়েছে।
ভারতের বিদেশ মন্ত্রক (MEA) এই বিষয়ে জানায় যে বিষয়টি ‘সম্পূর্ণরূপে আইনি এবং বিচারবিভাগীয়’, যার জন্য দুই সরকারের মধ্যে আনুষ্ঠানিক আলোচনার প্রয়োজন। তবে আইনি বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, চুক্তিতে এমন কিছু ‘ফাঁক’ বা ‘ছাড়’ রয়েছে, যা ভারতকে এই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করার সুযোগ দেবে।
🔑 চুক্তির মূল বাধা: রাজনৈতিক অপরাধের ধারা
২০১৩ সালে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত এই প্রত্যর্পণ চুক্তিতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ধারা রয়েছে, যা নয়াদিল্লিকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে বিশাল সুযোগ করে দিয়েছে।
১. রাজনৈতিক অপরাধের ব্যতিক্রম (The Political Offence Exception)
- ধারা ৬(১): চুক্তিতে স্পষ্ট বলা আছে, যদি কোনও অপরাধকে ‘রাজনৈতিক চরিত্রের অপরাধ’ (Offence of a Political Character) বলে মনে করা হয়, তবে প্রত্যর্পণের অনুরোধ বাতিল করা যেতে পারে।
- বিশ্লেষণ: যেহেতু শেখ হাসিনা একটি রাজনৈতিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন এবং বর্তমানে তাঁর রাজনৈতিক বিরোধীরাই বাংলাদেশে ক্ষমতায়, তাই এই রায়কে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে আখ্যা দেওয়ার সুযোগ ভারতের সামনে রয়েছে। ভারত যুক্তি দিতে পারে যে, এই বিচার এবং সাজা দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য।
২. সদিচ্ছা এবং ন্যায়বিচারের স্বার্থ (Good Faith and Interests of Justice)
- ধারা ৮(৩): এই ধারা ভারতকে ক্ষমতা দেয় যে, যদি মনে হয় প্রত্যর্পণের আবেদন ‘সদিচ্ছায় করা হয়নি’ (Not made in good faith) অথবা এটি ‘ন্যায়বিচারের স্বার্থে নয়’, তবে অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করা যেতে পারে।
- বিশ্লেষণ: আদালতের রায়ে তাড়াহুড়ো এবং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে অনুপস্থিতিতে (In Absentia) মৃত্যুদণ্ড দেওয়া—এই সমস্ত বিষয় ইঙ্গিত করে যে বিচার প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থাকতে পারে। ফলস্বরূপ, ভারত এই ধারা প্রয়োগ করে হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়া বৈধ করতে পারে।
৩. দ্বৈত অপরাধের শর্ত (Dual Criminality)
- ধারা ১ ও ২: প্রত্যর্পণ করতে হলে অভিযুক্ত অপরাধ উভয় দেশের আইনে শাস্তিযোগ্য হতে হবে। যদিও ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী স্বীকৃত, তবুও ভারত এটিকে দেশীয় রাজনৈতিক ঘটনার নিরিখে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করার সুযোগ রাখে।
🇮🇳 ভারতের অবস্থান এবং ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা
আইনি বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, চুক্তির ধারাগুলি ভারতকে প্রত্যর্পণের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করার আইনি অধিকার দিয়েছে। এছাড়াও, ভারতের সিদ্ধান্ত কেবল আইনি বাধ্যবাধকতার উপর নয়, বরং ভূ-রাজনৈতিক বিবেচনার উপরও নির্ভরশীল:
- ঐতিহাসিক সম্পর্ক: বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে দীর্ঘকাল ধরে আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনার পরিবারের সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।
- আঞ্চলিক বার্তা: ভারতের একজন ‘ঘনিষ্ঠ বন্ধু’কে এমন এক সংবেদনশীল মুহূর্তে চরম সাজার মুখোমুখি হওয়ার জন্য হস্তান্তর করলে তা অন্যান্য বন্ধুপ্রতিম দেশগুলির কাছে ভুল বার্তা দিতে পারে।
উপসংহার: যদিও ঢাকা কূটনৈতিকভাবে চাপ অব্যাহত রেখেছে, তবে চুক্তির ফাঁকফোকর এবং ভারতের অভ্যন্তরীণ প্রত্যর্পণ আইন (Extradition Act, 1962)-এর বিধানগুলি বিবেচনা করে বিশেষজ্ঞরা একমত যে, শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের হাতে তুলে দেওয়ার কোনও আইনি বাধ্যবাধকতা বা পরিকল্পনা নয়াদিল্লির নেই। বরং, ভারত এই বিষয়টি বিচক্ষণতা ও কূটনীতিক কৌশলের সঙ্গে মোকাবিলা করে যাবে।





